বাবাজী বলেছিলেন, সাধু মানেই জটাধারী নন, ওটা একটা প্রতীক। সাধু মানে জগতসেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি সন্ন্যাসী হতে পারেন, গৃহস্থ হতে পারেন, কিংবা একজন বৈজ্ঞানীকও হতে পারেন। সাধন মার্গের প্রথম ভূমি অর্থাৎ বিষয়কে বিষ জ্ঞান হয়েছে কি না, এটা প্রথমে ভেবে নেওয়া দরকার। তারপর আছে আরও ৬ টি ভূমি। সন্ন্যাসী যদি অর্থের পিছনে ছোটে, তাহলে বেশিরভাগ গৃহীর সঙ্গে সাধকের আর পার্থক্য থাকে না।
জগতকে অস্বীকার করে জীবন চলতে পারে না। কারণ খালি পেটে ধর্ম হয় না। যদি, তাই হত, তাহলে সাধু-সন্ন্যাসীরা কোনরকম অর্থের ব্যবহার ছাড়াই জীবন কাটাতে পারতেন। তাই, ধর্মের পথে অগ্রসর হতে হলে জগত ও ঈশ্বরকে নিয়ে চলতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দ যা বলে গেছেন, বাবাজী মহারাজ সেই পথেই অগ্রসর হয়েছেন। যা কিছু, ভ্রান্ত ধারণা, যা কিছু কুসংষ্কার, তাকে সযত্নে পরিহার করার কথা বলে গেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসংগ টেনে তিনি একবার বলেছিলেন –
শ্রীরামকৃষ্ণদেব একবার খবরের কাজ দেখে বলেছিলেন, ‘ওসব পড়িস না। ওতে পরনিন্দা-পরচর্চা থাকে।“ বহু বছর পর স্বামীজীকে দেখা গেল গভীর মনযোগ দিয়ে খবরের কাজ পড়ছেন।
এক ভক্ত অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন।
তারপর স্বামীজীর কাছে গিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “শুনেছিলাম, ঠাকুর বলেছিলেন, খবরের কাগজে পরনিন্দা-পরচর্চা থাকে।“
স্বামীজী হেসে বলেছিলেন, “ঠিকই শুনেছিলেন, তবে যুগ পাল্টেছে।“
বাবাজী মহারাজ এই সময়ের পরিবর্তনকে সঠিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, আধুনিক ভারত, বিজ্ঞান-চর্চায় অনেক এগিয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের মানুষজন বিজ্ঞানের আলোকে সবকিছু বিচার করে নিতে চায়। তারা সহজে যেমন অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাসী হয়না, তেমনি, তার সঠিক ব্যাখ্যা পেলে সন্তুষ্ট হয়।
বাবাজী তাই, বর্তমানের আলোকে বারবার ভাগবত গীতা, মহাভারতের ব্যাখ্যা করতেন। অত্যন্ত সহজ বোধগম্য ভাষায় বর্তমান সময়ের উপযোগী করে বোঝাতেন।
কারণ, ধর্মের ব্যাখ্যা যদি জটিল করে লেখা হয় বা বোঝানো হয়, তাতে এই প্রজন্মের কাউকে আকৃষ্ট করা যাবে না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও সেই যুগে থেকে এটা বুঝেছিলেন।
তাই কথামৃত এর কাহিনী অতি সহজেই মনের গভীরে গিয়ে ধাক্কা দেয়, রেখে যায় তার ছায়া।
তিনি বলেছিলেন, পূজা মানে হল মাকে একবার বাইরে নিয়ে আসা, আর বিসর্জনের মাধ্যমে আবার ভিতরে নিয়ে যাওয়া।
ধর্ম জীবনের একটা অঙ্গ, নিজেকে চেনার একটা মাধ্যম, কোন পথ সঠিক, কোন পথটা খারাপ দিকে বেঁকে গেছে, তা চিনিয়ে দেয় ধর্ম।
ধর্মাচরণ মানে ফুল-ফল-ধূপ-ধূনো নয়, ধর্ম মানে ডিজে বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য করে ‘মা মা’ বলে চিৎকার নয়।
ধর্ম মানে নিজ আত্মাকে জানা।
কারণ, ঈশ্বর দেবালয়ে থাকেন না, থাকেন মানুষের মনের গভীরে। সেখানেই তার সিংহাসন পাতা। যিনি মনের সেই অতলে যেতে পারবেন, তিনিই খুঁজে পাবেন তার ‘মনের মানুষ’কে। যার অপর নাম ঈশ্বর।
তাই বাবাজী মহারাজ বলেছিলেন, ২৪ ঘন্টার দিন থেকে মাত্র একটা করে মিনিট কেটে নাও। তোমার হাতে থাকবে, সারাদিনে মোট ২৪ টা মিনিট। আর এই ২৪ মিনিটকে কাজে লাগাও আত্মানুসন্ধানে। আর এটা যদি করতে পারো নিয়ম মেনে প্রতিদিন, তাহলে আগামি এক বছরেই বদলে যাবে তোমার জীবন।
কী করতে হবে এই ২৪ মিনিট?
বাবাজী বলছেন, আজ সংসারের নানা কর্মে আমরা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না। যেদিন এই নিজেকে খুঁজে পাবে, নিজের আত্মাকে খুঁজে পাবে, বুঝতে পারবে, তিনিই তোমার শিক্ষক। তখন প্রত্যেকটা পদক্ষেপে আর ভুল হবে না।
যখন রাত্রি হবে, অথবা একেবারে সকাল বেলা, যখন চারিদিক নিস্তব্ধ থাকে, সেই সময়ে মাত্র ২৪ মিনিট ব্যয় করো আত্মানুসন্ধনে।
যার যা ঈশ্বর, অর্থাৎ যে যাকে তার ইষ্টদেব মানে, তার সামনে নিদেনপক্ষে একটা ধূপ দেখিয়ে প্রার্থনায় বোসো। সম্ভব হলে একটু ধ্যান কোরো।
একদিনে হয়ত মনকে বশে আনা যাবে না, তবে নিয়ম মেনে প্রতিদিন এটা করতে পারলে, একসময় মন তোমার অধীনে চলে আসবে।
আর তখন থেকেই শুরু হবে আত্ম অনুসন্ধানের কাজ।
আর সকালে এই কাজটা করতে পারলে সারাটা দিন মন সতর্ক থাকবে, তুমি যা কিছুই করবে তাতে মনঃসংযোগ থাকবে। আর এটাই তোমার জীবন পথের চালক হয়ে উঠবে। ছোট থেকে এই অভ্যাসটা করলে, পরে আর অসুবিধা হবে না।
ছাত্রজীবনে এই অভ্যাস তাদের পরীক্ষায় ভাল ফল করতে সাহায্য করবে। জীবন শৃঙ্খলাযুক্ত হবে। তিনি বলেছেন, বর্তমান যুব সমাজের একটা স্থির চিন্তা নেই, হারিয়ে যাচ্ছে শৃঙ্খলা। সব ফিরে আসবে মাত্র দিনে ২৪ টা মিনিট ব্যয় করলে।